শুক্রবার ৭ নভেম্বর ২০২৫ - ০৯:৪৮
আমলহীন জ্ঞান মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না— আয়াতুল্লাহ খুশওয়াক্ত

নৈতিকতার গভীর ব্যাখ্যায় আয়াতুল্লাহ আজিজুল্লাহ খুশওয়াক্ত (রহ.) বলেন, মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণ করে তার জ্ঞান নয়, বরং জ্ঞানের আলোয় গঠিত কর্ম ও আমল। কুরআনের দিকনির্দেশনা, নসিহত ও উপদেশ তখনই হৃদয়ে প্রভাব ফেলে— যখন মানুষ তা আমলের মাধ্যমে জীবনে বাস্তবায়ন করে। গাফিলতার অভ্যাস ও নফসের প্রলোভন মানুষকে সত্যের পথ থেকে দূরে সরায়, আর মুক্তির একমাত্র পথ হলো সৎকর্ম ও আল্লাহর প্রতি আন্তরিক প্রত্যাবর্তন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি:  সমকালীন যুগের অন্যতম খ্যাতিমান নৈতিক শিক্ষক হযরত আয়াতুল্লাহ আজিজুল্লাহ খুশওয়াক্ত (রহ.) তাঁর এক মূল্যবান নৈতিকতার পাঠে “মানুষের জীবনে কর্মের গুরুত্ব” বিষয়ে গভীর ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। মানবজীবনের আত্মিক গঠন, দায়িত্ববোধ, ঈমানের স্থায়িত্ব ও আল্লাহর সামনে হিসাবদানের প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে তিনি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য পেশ করেন। তাঁর শিক্ষার সেই গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিম্নরূপ:

আয়াতের ব্যাখ্যা: মানুষের আমলই তার সাথী
তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করেন—

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
وَكُلَّ إِنسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَائِرَهُ فِي عُنُقِهِ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا

তিনি ব্যাখ্যা করেন, এই আয়াতে “طائر” দ্বারা বোঝানো হয়েছে মানুষের নিজস্ব কর্ম ও আমল—নতার সব কাজ, চিন্তা, সিদ্ধান্ত ও আচরণের ফল। প্রতিটি মানুষ তার কাজকে নিজের গলায় ঝুলন্ত দায় হিসেবে বহন করে; এ কর্মফল থেকে কখনো সে পৃথক হতে পারে না। তা সে ভালো হোক বা মন্দ—সবকিছু তার অস্তিত্বে গভীরভাবে লিপিবদ্ধ হয়।

কেউ কারো দায় বহন করবে না
তিনি বলেন— মানুষ যা করে তার পরিণাম তার নিজের ওপরই বর্তায়; কেউ অন্যের দায়িত্ব নেবে না। কুরআন বারবার ঘোষণা করে:

“لا تزر وازرة وزر أخرى”
কেউ অন্যের বোঝা বহন করবে না।

এটি মানুষকে সচেতন করে যে আল্লাহর দরবারে প্রত্যেকেই নিজের আমলের জন্য দাঁড়াবে এবং তারই জবাবদিহি করবে।

আমল— মানবজীবনের কেন্দ্রবিন্দু
তিনি বলেন, মানবজীবনে কর্ম এমন একটি উপাদান যা একদিকে ব্যক্তিগত, অন্যদিকে সার্বজনীন ও ভিত্তিমূল। এটি শুধু আধ্যাত্মিক উন্নতি বা দুনিয়ার সমৃদ্ধির মাধ্যম নয়; বরং কিয়ামতের সাফল্যেরও প্রধান নির্ণায়ক।

নবীগণ স্বভাবতই আমলের মানুষ ছিলেন— তাদের সচেতনতা, দৃঢ়তা ও দায়িত্ববোধ এতটাই প্রবল ছিল যে অতিরিক্ত উপদেশের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা নানাভাবে বিভ্রান্তি, অবহেলা ও নফসের প্রলোভনে আক্রান্ত হই। তাই বারবার স্মরণ, দিকনির্দেশ ও আত্মজিজ্ঞাসা আমাদের জন্য আবশ্যক।

কেন কুরআন একই শিক্ষা বারবার পুনরাবৃত্তি করে?
তিনি ব্যাখ্যা করেন— একটি সূরাতেই আমরা দেখতে পাই, কোনো কোনো শিক্ষা বিভিন্ন ভাষায় বারবার পুনরাবৃত্ত হয়:

- কখনো কোমল আহ্বানে,

- কখনো তীব্র সতর্কতায়,

- কখনো অনুপ্রেরণাদায়ী উৎসাহে।

আল্লাহ বলেন—

وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَىٰ تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِين
স্মরণ করিয়ে দাও— স্মরণ মুমিনদের উপকারে
আসে

কারণ? মানবহৃদয়ের অবস্থাও পরিবর্তিত হয়
মানুষ সবসময় একই মানসিক অবস্থা, মনোযোগ বা আধ্যাত্মিক প্রস্তুতিতে থাকে না। কখনো সে গ্রহণযোগ্য অবস্থায় থাকে, কখনো থাকে না। তাই আল্লাহর বাণীও তখনই কার্যকর হয় যখন হৃদয় তার জন্য উপযুক্ত হয়।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কেন মানুষের মধ্যে পার্থক্য হয়?
তিনি বলেন— ইমান ও সৎকর্ম জবরদস্তিমূলক নয়; বরং তা নির্ভর করে:
• হৃদয়ের প্রস্তুতি,
• সঠিক উপলব্ধি,
• নফসের সাথে সংগ্রাম,
• এবং আল্লাহর সাহায্যের ওপর।

কেউ তরুণ বয়সে জেগে ওঠে, কেউ মধ্যবয়সে নিজেকে বদলায়, কেউ বৃদ্ধ বয়সে সত্যের দিকে ধাবিত হয়। এই পার্থক্য স্বাভাবিক, কারণ প্রত্যেক মানুষের অন্তর্গত যাত্রা আলাদা।

অভ্যাস বদলানো কঠিন—নফসের অভ্যাস আরও কঠিন
তিনি গভীরভাবে উল্লেখ করেন— মানুষের সবচেয়ে বড় বাধা হলো তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। যে আচরণ সে বছরের পর বছর করেছে, যে আচার নফস তাকে বারবার করিয়েছে, সেটি ত্যাগ করা সহজ নয়।

এ কারণে মানুষ বারবার আল্লাহর উপদেশ শুনলেও:
• কাজ করতে দেরি করে,
• সিদ্ধান্ত নেয় না,
• সত্যকে গ্রহণ করেও বাস্তবে রূপ দেয় না।

যে সত্যের কথা শুনে কর্মে নামল না— আসলে সে সত্যকে “শোনেনি”— কারণ সত্য তখনই শোনা হয়, যখন তা হৃদয়ে প্রভাব ফেলে এবং মানুষকে বদলায়।

গাফিলতার অভ্যাস মানুষকে পঙ্গু করে দেয়
তিনি বলেন— মানুষ যদি অবহেলা, গুনাহ ও শৈথিল্যে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তবে তার ফিরে আসা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।

অভ্যাস যত গভীর হয়, পাল্টানোর শক্তি তত দুর্বল হয়। এজন্য প্রথম সুযোগেই সাড়া দিতে হয়— কারণ বিলম্ব যত বাড়ে, হৃদয়ের কঠোরতাও তত বাড়ে।

শুধু জ্ঞান নিরর্থক—আমলই একমাত্র মুক্তির পথ
তিনি জোর দিয়ে বলেন— জ্ঞান, উপদেশ, আলোচনা, গবেষণা— সবই তখনই অর্থবহ, যখন তা কর্মে রূপ নেয়।

শুধু জ্ঞান অর্জনে মুক্তি নেই। শুধু বললে লাভ নেই। শুধু কিতাব লিখলে পরিবর্তন আসে না। ঈমান তখনই সম্পূর্ণ হয়, যখন তা কার্যকর বাস্তবতা ও আমলে প্রকাশ পায়।

যারা সত্য শুনেও আচার-আচরণে তা বাস্তবায়ন করে না— তারা সেইসব মানুষের মতো যাদের সম্পর্কে কুরআনে কঠোর শাস্তির সতর্কতা এসেছে।

তিনি শেষ করেন এ প্রার্থনা দিয়ে— আমরা যেন আল্লাহর বাণী হৃদয় দিয়ে শুনতে পারি, প্রথমবার শোনার সাথেই কর্মে পরিণত করার তৌফিক লাভ করি, এবং আমাদের আমল যেন আমাদের জন্য উদ্ধার ও মুক্তির মাধ্যম হয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সেই তৌফিক দান করুন।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha